Mar 1, 2008

সম্পাদকের কথা

ইতিহাসের করুণতম গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ প্রকৃত প্রস্তাবে একটি বিশাল সমাধি ক্ষেত্র। এই শ্যামল মাটির প্রতিটি কণা স্বাথীনতার জন্য আত্মদানকারী শহীদের পবিত্র রক্তে পতে-পরিশুদ্ধ। আমরা জীবিত যারা এই পবিত্র ভূমিতে বিচরণ করি তারা প্রতিদিন এই মৃত্তিকার গভীরে প্রোথিত কোন না কোন পবিত্র শহীদের লাশের উপর দিয়ে হাঁটি। যদি মূহুর্তের জন্য আমরা থমকে দাঁড়িয়ে একবা ভেবে দেখি, তা হলে—এই মাটির যেখানেই আমরা দাঁড়াই না কেন, আমাদের দুষ্টিসীমার মধ্যে থাকবে ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর লব্ধ মহাবিজয়ের পর আবিষ্কুত কয়েক সহস্র গণসমাধির কোন না কোনটি। যদি আমরা প্রতিটি শহীদের জন্য স্মৃতির মিনার বানাই, তাহলে এই দেশ হয়ে যাবে মিনারের দেশ। এই শোণিত-শুদ্ধ মাটির উপর দিয়ে আমাদের সর্বদা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে হাঁটা উচিত, কারণ যাঁরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের বর্তমানকে উৎসর্হ করে গিয়েছেন, তাঁরা আছেন এ’ভূমির সর্বত্র।

এই সমাধি নির্মাণ করেছিল পাকিস্থানী বাহিনীর এক লক্ষ সশস্ত্র জন্তু আর তাদের এদেশীয় দোসর ৭ লক্ষ বিশ্বাসঘাতক দালাল। ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর এই সমাধি ক্ষেত্রে জীবনের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল।

কিন্তু সেদিন থেকেই অযোগ্য, অকৃতজ্ঞ আমরা নিজেরাই আরেকটি সমাধি গড়ার কাজ শুরু করেছি-মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর চেতনাকে বিকৃতি আর বিস্মৃতির গর্ভে সমাধিস্থ করার কাজ। স্বাধিনতার পর থেকেই ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার দায়ে দায়ী যুদ্ধাপরাধী পাকসেনা এবং দেশীয় দালালদের মানবতা ও ন্যায় বিচারের সমস্ত দাবীকে উপেক্ষা করে বিনা তদন্তে বিনা বিচারে ছেড়ে দেবার কাজ শুরু হয়। তারপর পুনর্বাসনের নানা পর্যায় পেরিয়ে সেদিনের সেই ফেরারী খুনী দালালরাই আজ আমাদের সরকার সমাজ, রাজনীতি আর অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আসনে প্রবল প্রতাপে আসীন হয়ে স্বজনহারা দেশবাসীকে দুঃশাসনের শত শৃংখলে আবদ্ধ করেছেন। যে নরমেধযজ্ঞে তিরিশ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের অকল্পনীয় নৃশংসতায় নির্মৃল করা হয়েছে, সেই হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত একজন সামরিক অফিসারের বিচারও আমরা করিনি। স্বদেশে আমরা গগনচুম্বী সৌম্য সৌধ গড়েছি ’৭১ এর অনিঃশেষিত প্রাণ মহীদানের স্মরণে। প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় স্মরণ সঙ্গীতের মূর্চ্ছনার সাথে সাথে প্রদর্শিত হয় সেই সৌধ। কিন্তু তারপরেই হয়ত উপায়হীন আক্রোশের সাথে আমাদের দেখতে হয়, নাম না জানা শহীদের গণকবরের উপর নির্মিত সৌধের পাদদেশে সহাস্যে দাঁড়িয়ে একাত্তরের প্রমাণিত খুনী দালাল মন্ত্রীর মর্যাদায় বিদেশী অভ্যাগতদের স্বাগত জানাচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী দালালরা আজ আমাদের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয়। হত্যা পরিকল্পনার মূল কেন্দ্র পাকিস্তানে গিয়ে ঘোষণা করে আসে, বাঙালী জাতি ’৭১-এ স্বাধীনতা পেয়ে আজ অনুতপ্ত। বাঙালীর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা যে জয়বাংলা শ্লোগানে একদিন প্রকম্পিত হয়েছিল বাংলাদেশের আকাশ বাতাস, তাকে আজ স্থানচ্যুত করেছে বিজাতীয় ভাষার নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আজ সর্বাত্মকভাবে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। আমাদের শিশুরা জানেনা আমাদের জাতির পিতা কে। তারা জানে একাত্তরে আমরা 'হানাদার’ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এই ’হানাদার’ কারা, তা তারা জানেনা, কেউ কেউ জানে ’হানাদার বাহিনী’ হল ভারতীয় বাহিনী। রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কারা ছিল তা তারা জানে না।

সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র আর ধর্ম নিরপেক্ষতাকে নির্বাসিত করা হয়েছে। একচক্ষু সাম্প্রদায়িকতার যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা আমাদের পিতা এবং ভ্রাতার নির্মম হত্যাকান্ডের আর মাতা এবং ভগ্নীর লাঞ্ছনার কারণ হয়েছে, তা আজ দিনে দিনে আমাদের মস্তিস্কের গভীরে আমূল প্রোথিত করা হচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্মগত অধিকারকে উপেক্ষা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ছত্রছায়ায় চালু করা হয়েছে অদ্ভুত লুটেরা অর্থব্যবস্থা।

এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায়না। আমরা এই অবস্থা চলতে দেব না, চলতে দিতে পারিনা। অনেকে বলে থাকেন, একটি শিশু জন্মাতেও সময় নেয় দশ মাস ; মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে যেভাবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তাতে অকালে জন্মনো শিশুর মতই বাংলাদেশও হয়েছে জন্মলগ্ন থেকেই ব্যধিগ্রস্থ, সম্ভবনাহীন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, ওই নয় মাসেই যে রক্তমূল্য আমরা দিয়েছি, তা আর কোন জাতি কখনও দেয়নি। আমাদের স্বাচ্ছন্দ বর্তমানের জন্য, আমাদের অনাগত বংশজদের সমৃদ্ধি ভবিষ্যতের জন্য প্রদেয় মূল্যের অতিরিক্ত আমরা ইতিমধ্যেই পরিশোধ করেছি। এখন আমাদের সুফল ভোগ করার সময়।

সে উদ্দেশ্যে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে, একাত্তরের সেই ঘোর দুর্দিনে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল আপন দেশবাসীর সাথে, যারা আজও ষড়যন্ত্রের সহস্র জাল বিস্তার করে রেখেছে এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, তাদের চিহ্নিত করে সমাজের কর্তৃত্ব তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়া। এ’কোন অলৌকিক কথা নয়। গণহত্যার শিকার বিশ্বের অন্যান্য জাতি স্বাধীনতাপ্রাপ্তির বহু বছর পরও খুনী দালালদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের বিভিন্ন দেশে যারা দালালী করেছে, তাদের অনুসন্ধান ও যথোচিত শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়া আজও সক্রিয় রয়েছে। মাত্র গত মাসেই জাতিসংঘ ৫ হাজার সন্দেহভাজন নাৎসী পার্টি সদস্যের তালিকা প্রকাশ করেছে, তদন্তের পর এদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হবে। এসব দেশে গণহত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলনা, অথচ গণহত্যাকে সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছে এ ধরণের সাধারণ দালালদেরও ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকার ভোটাধিকার রহিত করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি সমূহের দূরদৃষ্টির অভাব এবং অনৈক্যের কারণে আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুন্ঠিত। কিন্তু আমাদের দৃঢ় আস্থা আছে, একাত্তরে আমরা যে অতুল্য আত্মত্যাগ আর বীর্য্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছি, তাকে জাতীয় কর্মকান্ডেযর অনুপ্রেরণার মূল উৎস হিসেবে স্থাপন করার মত শুভবুদ্ধি, সাহস আর সক্রিয়তা একদিন পুনরুজ্জীবিত হবেই। বিশ্বের সভায় আজ আমাদের দাঁড়াতে হচ্ছে দীন, ঐতিহ্যহীন, ক্ষমতাহীন, নতশির হয়ে। কিন্তু একদিন আমরা অনুধাবন করবই যে বীর্য্যে আত্মত্যাগে আর ঐতিহ্যে আমরা কোন জাতির চেয়ে কখনই কম নই বরং অগ্রসর। এই আত্মবিস্মৃতির অন্ধরাত্রি একদিন কাটবেই। গৌরবময় বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরের মত আবার আমরা জেগে উঠবই। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অগণন মানুষের আত্মদান কখনও বুথা যায় না। আজ হোক কাল হোক, এদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই।

এই সুগভীর আস্থা থেকেই স্বাধীনতা বিরোধী দালালদের চিহ্নিত করার কাজে আমার সীমিত সামর্থ্যকে নিয়োগ করেছি। একাত্তরের মূলস্বাধীনতা বিরোধী সংগঠনগুলি গড়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মূখ্য দালালদের তৎকালীন কার্যক্রম, তাদের পুর্বাসনের সাধারণ পটভূমি, এবং তাদের বর্তমান অবস্থানের বর্ণনা দেয়ে লেখিত দলিলের ভিত্তেতে আমি গতবছর ’একত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থটি রচনা করি মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। তথ্যের অপ্রতুলতা সত্বেও গ্রন্থটি বিপুলভাবে সমাদৃত হওয়ায় এ’কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিস্মৃত হয়নি, বরং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অনীহা কিংবা অবহেলার কারণেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জাতীয় জীবনে তার দিক নির্ণায়ক ভূমিকাটুকু পালন করতে পারছেনা। ঘাতক ও দালালদের কর্মকান্ডের ইতিহাস উন্মোচনে গ্রন্থটির সম্ভাব্য ভূমিকা বিবেচনা করে গ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণকারী সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র এ’টিকে তাঁদের পূর্ব পরিকল্পিত তিন খন্ডের ইতিহাস প্রকল্পের প্রথম খন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বইটিকে কয়েক খন্ডে বৃহদাকার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থে রূপান্তরিত করার অঙ্গীকার তাঁরা ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে অভিজ্ঞ ইতিহাসবিদের তত্বাবধানে গ্রন্থটিকে পরিমার্জিত করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের সুযোগ্য ও নিবেদিত প্রাণ নির্বাহীদের তত্বাবধানে আমার ওই ক্ষুদ্র প্রয়াসটি দালালদের কর্মকান্ডের ইতিহাস উন্মোচনে ক্রমাগত অধিকতর ভূমিকা রাখবে।

দালাল আইনে অভিযুক্তদের তালিকা সংকলন করে বর্তমান গ্রন্থটি গ্রন্থণার অনুপ্রেরণাও আমি একই বিশ্বাস থেকে লাভ করেছি। সরকারী উদ্যোগে তথাকথিত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হবার পর থেকেই বিভিন্ন সংস্থা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নয় বরং দালালদের তালিকা প্রণয়নের দাবী উঠে। মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ এ বিষয়ে প্রথমেই তাদের জোরালো বক্তব্য রেখেছিল। একই ভাবে সচেতন অন্যান্য সংগঠনও ক্রমশঃ এ বিষয়ে দাবী তোলে। দেশবাসী এই দাবীর যৌক্তিকতা অনুধাবন করলে দালাল তালিকা প্রণয়ন বন্ধারে দালালদের তালিকা প্রণয়ন করার দাবী জানায়। কয়েক দফা সংসদে বিরোধী দলীয় কতিপয় সদস্য গ্রন্থটির কয়েকটি স্থান উদ্ধৃত করে বক্তব্য রাখলে বিতর্কেরসৃষ্টি হয়। চুড়ান্ত পর্যায়ে ’৮০ র ৩ ’মার্চ’ জাতীয় সংসদে এবিষয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। সংসদে বিরোধী দলীয় আওয়ামী লীগ সদস্য মোশাররফ হোসেন এ’ব্যাপারে জরুরী জনগুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন করলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর জবাবের পর এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা দালালদের তালিকা প্রণয়ন করার জোর দাবী জানিয়ে বক্তব্য প্রদানের এক পর্যায়ে বলেন, ’আজ যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে তেমনিভাবে কারা টিক্কা, রাও ফরমান আলীর সহযোগী ছিল, কারা রাজাকার আলবদর ছিল, ’৭২ সলের সংবাদপত্র দেখলে কারা স্বাধীনতার পর দালাল আইনে জেলে ছিল, কারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, এসব কিছু, ’৭২ সালের কাগজে পাওয়া যাবে এদের তালিকা প্রস্তুত করে কেন সরকার প্রকাশের উদ্যোগ নেন না। ( দৈনিক বাংলার বাণী-৩ মার্চ ’৮৭)

সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর এই বক্তব্যে আমি অনুধাবন করতে পারি যে, ১৯৭২ সালের দালাল আইনের অধীনে বিচারযোগ্য অপরাধের অভিযোগে যাদের কারারুদ্ধ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা একান্ত প্রয়োজন। ইতিপূর্বে ’একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ রচনার উদ্দেশ্যে তথ্যানুসন্ধানের এক পর্যায়ে আমি ১৯৭২-৭৩ সালের বাংলাদেশ গেজেট (এক্সট্রা অর্ডিনারী) র বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত দালাল আইনে অভিযুক্ত আসামীদের একটি ধারাবাহিক তালিকা আবিষ্কার করি। বিরোধী দলীয় নেত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এই তালিকা দালাল তালিকা হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে এ বিষয়টি অনুধাবন করে আমি এটি প্রকাশের জন্য কয়েকটি সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করি। এ’দের প্রত্যেকে এ বিষয়ে প্রশংসনীয় আগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। একটি ক্ষেত্রে আমি একজন অগ্রজ কবির আগ্রহের মর্যাদা দিতে না পারার বিশেষ লজ্জিত, কিন্তু এ’দের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদকেই তালিকাটি প্রকাশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সংগঠন বিবেচনা করে আমি তাদের মাধ্যমেই তালিকাটি প্রাকাশের সিদ্ধান্ত নিই। এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের উদ্যোগ ও প্রকাশনায় এবং আমার সম্পাদনায় দালাল আইনের অধীনে কারারুদ্ধ ৩৭ হাজার অভিযুক্তের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা কয়েকটি খন্ডে মুদ্রিত করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ৬ শতেরও বেশী অভিযুক্তের নাম ঠিকানা সম্বলিত এই তালিকা পরিকল্পিত খন্ড মালার ১ম খন্ড।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিভাগ এবং বিশেষ বিভাগ (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৮) জারী হবার পর থেকে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত এই তালিকা প্রকাশ করে। এটি ছিল প্রকৃত প্রস্তাবে দালাল আইনে অভিযুক্তদের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট আদালতে হাজির হবার সরকারী নোটিশ। সরকারের এ কথা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশ দালাল আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন এবং তিনি বিচার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেছেন কিংবা বিদেশে অবস্থান করছেন--নোটিশে এ কথা উল্লেখ করে আদালতে হাজিরা দেবার নির্দেশ দেওয়া ছাড়াও এই নোটিশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বনামে কিংবা বেনামে মালিকানাধীন যাবতীয় সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাংলাদেশ গেজেটে এই নোটিশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, নোটিশ প্রাপ্তদের অধিকাংশকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। অবশিষ্টরা আত্মগোপন করেছিল কিংবা দেশত্যাগ করেছিল।

অভিযুক্তদের মধ্যে কিছু সংখ্যকের, বিশেষতঃ নেতৃস্থানীয় দালালদের বিচার ও শাস্তি হলেও গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিচারের জন্য সাধারণতঃ যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, দালাল আইনে তার সংস্থান না থাকায় স্বভাবতই এই শাস্তি ছিল অপরাধের গুরুত্বের তুলনায় অকিঞ্চিতকর। তবে নোটিশপ্রাপ্ত দালালদের কেউই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করতে পারেনি।
একই কারণে বিচারের পর আদালত কয়েকজনকে খালাস প্রদান করেছে। তদন্তের পর অনেককে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়নি, দূর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি এর কারণ বলে ধারণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমার ফলে হাজার হাজার দালালদের অপরাধের তদন্ত বা বিচার কোনটিই হয়নি।

সরকারী নোটিশে যে ক্রমানুযায়ী অভিযুক্তদের নাম ছাপা হয়েছিল, এই তালিকাতেও সেই ক্রম রক্ষা করা হয়েছে। অনেক নেতৃস্থানীয় দালাল দালাল আইন জারীর আগেই গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় স্বভাবতই আলোচ্য তালিকায় তাদের নাম ওঠেনি। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বর্তমান গ্রন্থটি সংকলিত হওয়ায় এই দালালদের নাম প্রথম খন্ডে ছাপানো সম্ভব হল না। পরবর্তী খন্ডে এ’ধরনের দালালদের নাম ঠিকানা ও আদালতে হাজিরার সময় ও স্থান উল্লেখ করা ছাড়াও রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের দালালদের পূর্ণ তালিকা গ্রন্থবদ্ধ করা হবে, তালিকার ক্রমানুযায়ী প্রথম দিকে নাম ছাপা হয়নি বলেই কোন দালালের গুরুত্ব কম ছিল এমনটি ভাবার কোন হেতু নেই। এছাড়া দ্রুততার কারণে অভিযুক্ত প্রত্যেকের নামের পাশে তার বিচার হয়েছিল কিনা, বিচার হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে কোন কোন অপরাধের জন্য অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, কোন কোন অপরাধে কি কি শাস্তি হয়েছিল, কাকে কাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছিল, অভিযুক্তের বর্তমান অবস্থান ইত্যাদিসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্যাদি সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। আগামী সংস্করণে এই অসম্পূর্ণতা সংশোধন করা হবে তবে এই অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও তালিকাটির গুরুত্ব হ্রাস পাবে বলে আমার মনে হয়না, কারণ, দালাল আইনের অধীনে তদন্ত, বিচার ও শাস্তি কোনটিই প্রকৃত অপরাধীর কৃত অপরাধের গুরুত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। এই অসম্পূর্ণতার কারণেই বর্তমান তালিকাটিকে দালাল তালিকা না বলে দালাল আইনে অভিযুক্তদের তালিকা বলতে হচ্ছে।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের প্রতিটি শহর ও গ্রামের জনসাধারণ যেন জানতে পারেন, একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলিতে কাদের বিরুদ্ধে, কোন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে তারা লড়েছিলেন। আমার বিশ্বাস এই তালিকা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারা অন্ততঃ এদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনকে প্রতিরোধ করবেন।

আর যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন নিশ্চয়ই এদের অপরাধের যথার্থ তদন্ত হবে। মানবতাবাদী সংস্থাগুলোর সহায়তাও নিশ্চিত ভাবেই আমরা সুনিশ্চিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পরিশেষে ভিন্ন আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের শ্লোগান ’মুক্তিসংগ্রাম চলছে, চলবে’--- অত্যন্ত তাৎপর্যবহ একটি বক্তব্য। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে রাজনৈতিক মুক্তি লাভ করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে এ ক্ষেত্রে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে সংঘটিত নজীরবিহীন গণহত্যা সত্বেও স্বাধীনতা লাভের অর্ধযুগের মধ্যেই খুনী দালালরা রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বসে। আমাদের ইতিহাসের এই কলংকজনক অধ্যায় রচনায় রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সাথে সাথে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দায়ভাগও কম নয়। যদি স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই দালালদের চিহ্নিত করে তাদের ঘৃণা কার্যকলাপকে গ্রন্থবদ্ধ করা হত, তা হলে কোন সরকারই সাহস পেতনা তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার ক্ষমতার উচ্চাসনে আসীন করতে। আজ যখন আমরা দালালদের পরিচয় উদঘাটনে সচেষ্ট হয়েছি, তখন সর্বপ্রথম আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে এগিয়ে আসতে হবে, এ’বিষয়ে তাৎপর্যবহ গবেষণার জন্য। যথার্থ জনমত সৃষ্টি করা গেলে দালালদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনকে প্রতিরোধ করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়।

নবীন লেখক হিসেবে এক্ষেত্রে আমার ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমি ওয়কিবহাল, তাই আমি অগ্রজ গবেষকদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখতে চাই, তাঁরা যেন এ’বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকে নিয়োজিত করেন।

এ’বিষয়ে যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা আছে, আমার স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে আমি সে বিষয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই, ভবিষ্যত গবেষকদের তা হয়ত কাজে লাগতে পারে।

দালালদের ভূমিকা ইতিহাসবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাটি হল, জানা বিষয়কে মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় লিখিত দলিলের অপ্রাপ্যতা। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, জিয়াউর রহমানের সিনিয়র মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে দালাল আইনের অধীনে বিচার করে শান্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই তথ্যটিকে সমর্থন করার মত লিখিত দলিল পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তের পক্ষ সমর্থনকারী আইনজীবীর কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে বলেই এটি উল্লেখ করা গেল, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই তথ্য প্রদানকারী সূত্র হিসেবে তাঁর নাম ব্যবহার করতে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

অনেক সময় মুদ্রিত বিষয় এমনভাবে পাওয়া যায় যে, সেটিকে তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করা ইতিহাস রচনার সাধারণ নীতিমালার অন্তর্ভূক্ত হয়না। উদাহরণ স্বরূপ, প্রাক্তন মন্তী আনোয়ার জাহিদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ’একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ রচনার পর আমাকে অনেকের কাছেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে, তাতে আনোয়ার জাহিদের নাম নেই কেন। সমালোচকদের মতে আনোয়ার জাহিদ একাত্তরে ক্যান্টনমেন্টে মুরগী সরবরাহ করতেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিরোধীনেত্রী শেখ হাসিনাও এই প্রসজ্ঞটি উল্লেখ করে তাঁকে বিদ্রুপ করেছেন। ’৭২ এর এপ্রিলে দৈনিক গণকন্ঠে ’দালাল আনোয়ার জাহিদকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন?’ এই শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এতে বলা হয়, আনোয়ার জাহিদ স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় একটি গুন্ডাবাহিনী তৈরী করে গ্রামের গরীব কৃষকদের কাছ থেকে মুরগী, সবজী, গরু ইত্যাদি জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে সরবরাহ করতেন। যদিও আনোয়ার জাহিদ এই লেখার প্রতিবাদ করেননি তবু এই লেখাটিকে গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত করার সময় শোভনীয়তা ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রশ্ন দেখা দেয়। এই কারণেই ওই লেখাটির প্রসংগ প্রথম গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়নি। আনোয়ার জাহিদ অবশ্য ভাসানী ন্যাপের তৎকালীন সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফররত পি পি পি নেতা মওলানা কাওসার নিয়াজীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এই খবরটি একাত্তরের সংবাদপত্রে মুদ্রিত হয়েছিল।

তৃতীয় যে অসুবিধাটি রয়েছে তা হল এই যে, অনেক সময় স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তি পরবর্তীকালে এমন ভূমিকা গ্রহণ করেছেন যে তাঁর স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা দ্রন্থবদ্ধ করার ঔচিত্য সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয়। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তা একজন প্রথিতথশা বুদ্ধিজীবীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে ’শুভঙ্করের ফাঁকি’ নামে একটি ভিত্তিহীন ও আক্রমণাত্মক মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কথিকা পাঠ করতেন করতেন এবং দালালীর অভিযোগে তাঁকে নাকি গ্রেফতারও হতে হয়েছিল। অথচ তাঁর পরবর্তীকালের কার্যকলাপে তাঁকে স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তি বলে মনে হয়নি। তিনি এমন কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটির সদস্যও হয়েছিলেন।

এ সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করা গেলে দালালদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করা যেতে পারে। বস্তুতঃ একাত্তরের দালালদের ঘৃণ্য কার্যকলাপ সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, তার একটি অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর অংশমাত্র এ পর্যন্ত মূদ্রিত হয়েছে। আমি আশা করব, অগ্রজ গবেষকবৃন্দ এ বিষয়ে তাঁদের যোগ্যতাকে নিয়োজিত করবেন।

শফিক আহমেদ
১ ফাল্গুন, ১৩৯৪ বাং

No comments:

Post a Comment